ছাত্ররাজনীতি, বুয়েট ও ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’

বুয়েটে যা চলছিল, সেটাকে কি ছাত্ররাজনীতি বলা যায়? এটা কি কোনো দিক থেকে আমাদের ছাত্ররাজনীতির গৌরবান্বিত অধ্যায়ের ধারক বা বাহক, যা নিয়ে আমরা গর্ব করি? এ সময়ের ছাত্রনেতাদের কি আমাদের অতীতের ছাত্ররাজনীতির মশালবাহী বলা যায়?
ইলাস্ট্রেশন: বিপ্লব কুমার চক্রবর্তী

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ সম্প্রতি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, দেশের সেরা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় বুয়েটে আবারও দলীয় রাজনীতি শুরু করার। এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করে দেওয়া নোটিশের ওপর 'স্থগিতাদেশ' দিয়েছেন হাইকোর্ট। অপরদিকে, বুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাদের ক্যাম্পাসে আবারও ছাত্ররাজনীতি চালুর বিষয়ে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন—যার পেছনে রয়েছে বলিষ্ঠ, বেদনাদায়ক ও যৌক্তিক কারণ।

বুয়েটে ছাত্ররাজনীতির সর্বশেষ বলি ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ। বুয়েট ছাত্রলীগ নেতারা ক্রিকেট খেলার স্ট্যাম্প দিয়ে তার ওপর রাতভর পাশবিক নির্যাতন চালায়। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, অসহনীয় ব্যথা ও অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণে মৃত্যু হয়েছে আবরারের।

আবরারের এই মৃত্যু বুয়েট শিক্ষার্থীদের মনে যে দগদগে ঘা তৈরি করেছে, তার আর পুনরাবৃত্তি চায় না তারা।

কুষ্টিয়ায় মায়ের কোল থেকে ক্যাম্পাসে ফিরে আসার কয়েক ঘণ্টা পরেই আবরারের ওপর শুরু হয় নির্যাতন। তার একমাত্র 'অপরাধ' ছিল ফেসবুকে সমালোচনামূলক পোস্ট দেওয়া।

এটা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না। এটা ছিল ছাত্রলীগকে জবাবদিহি ও নজরদারির বাইরে রাখার কারণে তৈরি হওয়া এক সংস্কৃতির ফল। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পাশাপাশি ছাত্রলীগ একটি প্রশাসন তৈরি করে, যার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয় শিক্ষার্থীদের দৈনন্দিন জীবন, বিশেষ করে জুনিয়র শিক্ষার্থীদের। কোনো শিক্ষার্থী হলের সিট পাবে কি না, পেলে কোন হলের কোন সিট পাবে, দলীয় কার্যক্রমে তাদের কতটা অংশগ্রহণ করতে হবে এবং কতবার ও 'কীভাবে' নেতাদের 'সম্মান' জানাতে হবে, সেটাও নির্ধারণ করে দেয় এই প্রশাসন।

হলের ২০১১ নম্বর কক্ষটি ছিল কার্যত একটি টর্চার সেল, যেখানে অবাধ্য শিক্ষার্থীদের ধরে এনে বাধ্য করা হতো। আমরা হয়তো ভুলে গেছি, যখন বিএনপি ক্ষমতায় ছিল, তখন তাদের ছাত্র সংগঠন ছাত্রদলও একই কাজ করেছে। এ কারণে, সেইসব দিন আবারও ক্যাম্পাসে ফিরে আসার সামান্যতম সম্ভাবনাও সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে।

বুয়েটে যা চলছিল, সেটাকে কি ছাত্ররাজনীতি বলা যায়? এটা কি কোনো দিক থেকে আমাদের ছাত্ররাজনীতির গৌরবান্বিত অধ্যায়ের ধারক বা বাহক, যা নিয়ে আমরা গর্ব করি? এ সময়ের ছাত্রনেতাদের কি আমাদের অতীতের ছাত্ররাজনীতির মশালবাহী বলা যায়? কোথায় সেই দিকনির্দেশনা, আদর্শ ও আত্মত্যাগ? আজ ছাত্ররাজনীতির মুখোশের আড়ালে কেবল ক্ষমতা, সম্পদ ও ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধি। ছাত্ররাজনীতির সংস্কার না হলে আমাদের উচ্চশিক্ষার কেন্দ্রগুলোর কি কোনো ভবিষ্যৎ থাকবে?

চল্লিশের দশকের শেষের দিকে (পাকিস্তানের জন্মের পর), পঞ্চাশ ও ষাটের দশক এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রস্তুতির সময় (মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রদের ভূমিকা আলাদা রাখলে) আমাদের ছাত্ররাজনীতির ভিত্তি ছিল আদর্শ, অঙ্গীকার, আত্মত্যাগ, সততা ও জনগণের সেবা। ভাষা আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের ভূমিকা ছিল যেকোনো রাজনৈতিক দলের চেয়ে অনেক বেশি।

একই কথা আইয়ুব ও ইয়াহিয়া বিরোধী আন্দোলনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা দাবিকে তৃণমূল পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার কৃতিত্বের দাবিদার যতটা আওয়ামী লীগ, ঠিক ততটাই ছাত্রলীগ।

ঊনসত্তরের ১১ দফা কর্মসূচি দিয়েছিল মূলত বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলো, কিন্তু এর গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল ছাত্রলীগ। পরবর্তীতে এই আন্দোলন দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ ছাত্রআন্দোলন ও গণআন্দোলন হিসেবে পরিচিতি পায়। এই আন্দোলনের মাধ্যমে দীর্ঘ মেয়াদে ও সার্বিকভাবে সমাজে পরিবর্তন আনার বিষয়টি সামনে আসে, যা যেকোনো রাজনৈতিক দলের চিন্তাধারার চেয়ে সুদূরপ্রসারী ছিল।

স্বাধীনতাপূর্ব সময়ে আমাদের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস ও ঐতিহ্য শুধু গৌরবান্বিত ও অনুপ্রেরণাদায়কই নয়, বরং ছাত্ররা কীভাবে গণতান্ত্রিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারের মতো মৌলিক অধিকারের পাশাপাশি দরিদ্র ও সব ধরনের সুবিধাবঞ্চিত সম্প্রদায়ের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে পারে, তার একটি উজ্জ্বল উদাহরণ।

সেইসময়ে রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা পালন করেছে ছাত্ররাজনীতি এবং রাজনীতিবিদরা বাধ্য হয়েছে শিক্ষার্থীদের কর্মসূচিগুলোকে গ্রহণ করতে।

বাস্তবতা হলো, এখন আর এর কিছুই নেই।

তিন বছর আগে আমরা স্বাধীনতার ৫০তম বার্ষিকী উদযাপন করেছি। অনেক কিছুরই পরিবর্তন হয়েছে, বিশেষ করে অর্থনীতি ও অবকাঠামোতে। সেতু, সড়ক, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, মেট্রোরেল, বন্দর, বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র ও অন্যান্য জরুরি স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। এই মুহূর্তে কোন ধরনের ছাত্ররাজনীতি প্রয়োজন, তা নির্ধারণের কাজটি শুরু হতে পারে প্রধানমন্ত্রীর সর্বশেষ আহ্বান থেকে—'ডিজিটাল বাংলাদেশ' থেকে 'স্মার্ট বাংলাদেশে' রূপান্তর।

'স্মার্ট বাংলাদেশে' স্মার্ট শিক্ষার্থী প্রয়োজন। স্মার্ট শিক্ষার্থীদের প্রয়োজন স্মার্ট শিক্ষক এবং স্মার্ট শিক্ষকদের প্রয়োজন স্মার্ট বিশ্ববিদ্যালয়। যাতে তারা মুক্ত, সৃজনশীল ও গবেষণাবান্ধব পরিবেশে কাজ করতে পারেন এবং পরবর্তী প্রজন্মের বুদ্ধিজীবী, গবেষক, লেখক, সমালোচক, উদ্ভাবক, উদ্যোক্তা ও নেতা তৈরি করতে পারেন। তারা পারবেন একুশ শতকের হাত ধরে আসা সব ধরনের সুযোগকে বাস্তবতায় রূপান্তর করে আমাদের দোরগোড়ায় নিয়ে আসতে।

ছাত্ররাজনীতির বর্তমান প্রেক্ষাপটে এ ধরনের সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটানোর মতো পরিবেশ সৃষ্টির সম্ভাবনা কী আমরা কল্পনাও করতে পারি?

বেশিরভাগ সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, বিশেষত বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি শিক্ষকদের রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশে পরিণত হয়েছে। সেখানে শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক দিকনির্দেশনা দেন না, বরং শিক্ষার্থীরাই শিক্ষকদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থনে তাদের রাজনৈতিক সংগঠনের নির্বাচন কীভাবে হবে, তা নির্ধারণ করে দেয়।

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় রাজনীতিকরণের অবশ্যম্ভাবী ও ক্ষতিকারক প্রভাব হিসেবে প্রকৃত শিক্ষাবিদের স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন 'রাজনৈতিক' শিক্ষাবিদরা। চাকরিতে নিয়োগ, পদোন্নতি, লাভজনক পদায়ন, বৃত্তি, বিদেশ সফর, সরকারের সুরে সুর মেলানো 'পলিটিকালি কারেক্ট' শিক্ষাবিদদের লেখা বইয়ের প্রচারণা—সবকিছু মিলে সার্বিকভাবে আমাদের সৃজনশীলতাকে শ্বাসরুদ্ধ করে ফেলা হয়েছে। যার ফলে, 'জ্ঞানের বিশ্বে' উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে যে ধরনের উচ্চ পর্যায়ের শিক্ষা বা স্বীকৃতি প্রয়োজন, তা খুব কম মানুষই অর্জন করতে সক্ষম হয়।

এই সার্বিক পরিস্থিতির কারণেই সুনির্দিষ্ট প্রশ্ন উঠছে বুয়েট নিয়ে, যেটি আমাদের একমাত্র এমন প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিষয়ক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, যার কথা আমরা বড় গলায় বলতে পারি। এটাই আমাদের একমাত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, যার সঙ্গে ভারতের আইআইটির (ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি) তুলনা চলে। আমরা জানি, সারা বিশ্বে ভারতের নাম ছড়িয়ে দিতে আইআইটি কতটা অবদান রেখেছে।

বিশ্বের সব সুপরিচিত বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি রয়েছে, যা শিক্ষার্থীদের স্বার্থ ও অধিকার রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা পালন করে। নির্বাচিত শিক্ষার্থী প্রতিনিধিদের মাধ্যমে তারা কার্যক্রম পরিচালনা করে। প্রতিনিধিরা নিয়মিত ও নির্ধারিত সময়ে নির্বাচিত হন এবং নির্ধারিত মূলনীতি ও আইন মেনে চলেন। এই প্রতিনিধিরা শিক্ষার্থীদের স্বার্থ রক্ষায় শিক্ষক, ডিন ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে নিয়মিত ও কার্যকর আলোচনা করেন।

আমাদেরকেও যদি বিশ্বজুড়ে সমাদৃত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হয়, তাহলে অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের রাজনীতির বিষয়টি নিয়ে আবারও চিন্তা করতে হবে এবং একে ঢেলে সাজাতে হবে। বিশ্বে সুপরিচিত বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাজনীতি কেবলমাত্র শিক্ষার্থীদের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করে গেলেও আমাদের দেশে ছাত্ররাজনীতি তাদের মূল রাজনৈতিক দলের স্বার্থে নিবেদিত। এটাই মূল সমস্যা। এখানে এসেই আমাদের ছাত্ররাজনীতি আধুনিকায়নের চিন্তাগুলো ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের স্বল্পমেয়াদি স্বার্থের কাছে হেরে যায়।

আমরা উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যোগ দিতে যাচ্ছি। যার ফলে শিগগির দেশে যোগ্য মানবসম্পদের চাহিদা বড় আকারে বাড়বে। আমাদের কি সেই ধরনের জ্ঞানচর্চাকেন্দ্র আছে, যেখান থেকে আমাদেরকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম শিক্ষাবিদ তৈরি হবে?

বুয়েটকে আরও উন্নত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। একইসঙ্গে, আমাদেরকে প্রয়োজন অনুযায়ী মানবসম্পদ সরবরাহ করার জন্য একইমানের আরও কয়েক ডজন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে।

এখন যে ধারার ছাত্ররাজনীতি চলছে, সেটা আমাদেরকে ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নিতে পারবে না। যেহেতু বুয়েটে আবারও ছাত্ররাজনীতি চালু হতে যাচ্ছে, আমরা কি ভবিষ্যতের কথা ভেবে সেখানে এমন কিছুর সূত্রপাত করতে পারি, যা বিশ্বের অন্যান্য বিখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ইতোমধ্যে চালু আছে?

গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী, হাইকোর্টের সংক্ষিপ্ত আদেশের পর কার্যত বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি চালু করতে আর কোনো বাধা নেই। এখন আমাদের প্রবল ও আন্তরিক আশা হলো, পূর্ণাঙ্গ রায়ে ছাত্ররাজনীতির নামে কী করা যাবে, আর কী করা যাবে না—সে বিষয়ে যেন সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকে।

রাজনীতিতে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের অধিকার সমুন্নত রাখার পাশাপাশি হাইকোর্ট তার পূর্ণাঙ্গ রায়ের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ভয়-ভীতি প্রদর্শন, মৌখিক ও শারীরিক নির্যাতন এবং যেকোনো ধরনের সহিংসতার বিষয়ে সাবধান করে দিতে পারে। তেমনটি হলে শিক্ষার্থী ও শিক্ষক উভয়ে পক্ষের বহুল প্রতীক্ষিত ক্যাম্পাস রাজনীতির সংস্কার শুরু হতে পারে।

এখনই সময় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় নিয়ে নতুন করে চিন্তা শুরু করার, সেটি হচ্ছে আমাদের ভবিষ্যৎ।

মাহফুজ আনাম: সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার

ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments

The Daily Star  | English
What constitutes hurting religious sentiments

Column by Mahfuz Anam: What constitutes hurting religious sentiments?

The issue of religious tolerance have become a matter of great concern as we see a global rise in narrow-mindedness, prejudice and hatred.

8h ago