৭০ জনের প্রতিবাদ যেভাবে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় ইস্যুতে পরিণত হলো

স্কলারশিপ বাতিল, বহিষ্কার, গ্রেপ্তারের পরও ফিলিস্তিন ইস্যুতে অনড় যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা :
অস্টিনের টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনকারীদের মাটিতে ফেলে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। ছবি: রয়টার্স

আন্দোলনরত কয়েকশ শিক্ষার্থীর জমায়েতের মধ্যে ঢুকে সংঘর্ষে জড়ানো, টেনে হিঁচড়ে শিক্ষার্থীদের গণহারে গ্রেপ্তার, নারী অধ্যাপককে মাটিতে ফেলে হাতকড়া পরানো—মার্কিন পুলিশের এমন কর্মকাণ্ডে বিস্মিত গোটা বিশ্ব। মত প্রকাশের অধিকার, প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ প্রদর্শনের অধিকারে সর্বদা সোচ্চার যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পুলিশি অভিযান ও ধরপাকড় দেশটির সংবিধান, বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিমালা, ভাবমূর্তির সঙ্গে একেবারেই সাংঘর্ষিক।

টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনকারীদের গ্রেপ্তার করছে পুলিশ। ছবি: রয়টার্স

নিউইয়র্ক টাইমস বলছে, গত ১৮ এপ্রিল থেকে ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত ১০ দিনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৩০টির বেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে অভিযান চালিয়ে ফিলিস্তিনে গণহত্যার বিরুদ্ধে আন্দোলনরত ৮০০ জনের বেশি বিক্ষোভকারীকে আটক করেছে পুলিশ। কলাম্বিয়া, ইয়েল, হার্ভাড, এমআইটি, প্রিন্সটনসহ নামকরা সব বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের গণহারে বহিষ্কার, আবাসিক সুবিধা কেড়ে নেওয়া, স্কলারশিপ বাতিলের মতো ঘটনা ঘটছে। অন্যদিকে, আটককৃতদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অভিযোগে বিচার প্রক্রিয়া চলবে বলে কয়েকটি সূত্র জানিয়েছে।

অক্টোবরে হামাসের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের যুদ্ধ ঘোষণার পর যখন ফিলিস্তিনে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিষয়গুলো সামনে আসতে শুরু করে তখন থেকেই ছোট ছোট দলে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিক্ষোভ শুরু হয়। তবে গত ১০ দিনে এ বিক্ষোভ ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। এমনকি চলমান পুলিশি ধরপাকড়ের মধ্যেও যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে ক্যাম্পাসগুলোতে আন্দোলন দিনদিন তীব্র হচ্ছে।

৭০ জনের প্রতিবাদ যেভাবে জাতীয় ইস্যুতে পরিণত হলো

ইসরায়েলের গণহত্যার বিরুদ্ধে ছড়িয়ে পড়া বিক্ষোভের মুখে গত ডিসেম্বরে আইভি লিগ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধানদের কংগ্রেসে ডাকা হয়। ক্যাম্পাসে আন্দোলনের নামে 'অ্যান্টি-সেমিটিজম' বা 'ইহুদি বিদ্বেষ' ছড়ানো হচ্ছে এমন অভিযোগ তুলে মর্যাদাপূর্ণ আট বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধানদের দিকে আঙ্গুল তোলেন দেশটির নীতি নির্ধারকরা। তোপের মুখে পদত্যাগ করেন হার্ভার্ড ও পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট।

টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনকারীদের গ্রেপ্তার করছে পুলিশ। ছবি: রয়টার্স

গত ১৭ এপ্রিল ভোরে যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী তাঁবু খাটিয়ে দাবি আদায়ে অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেন। তাদের মূল দাবি, ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের চলমান যুদ্ধে সমর্থনকারী সংস্থাগুলোর সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক লেনদেন বন্ধ করতে হবে।

সেদিনই ক্যাম্পাসে 'ইহুদি-বিরোধী' কর্মকাণ্ডের জন্য ক্যাপিটল হিলে ডাক পড়ে কলাম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট ড. মিনোচে শাফিকের। প্রায় চার ঘণ্টা ধরে তাকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়েছিল। যার উত্তরে তিনি বলেছেন, 'এ বিষয়ে ইতোমধ্যেই ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।'

পরদিন নিউইয়র্ক পুলিশ ডিপার্টমেন্টে ফোন করেন ড. শাফিক। মূহুর্তের মধ্যেই পুলিশ বাহিনী ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে আন্দোলনকারী শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মারমুখী আচরণ শুরু করে। এসময় শতাধিক শিক্ষার্থীকে আটক করা হয়।

বিবিসির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এর আগে সর্বশেষ কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পুলিশ ঢুকে এমন গণহারে গ্রেপ্তার করেছিল পাঁচ দশকেরও বেশি আগে, ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রতিবাদ কর্মসূচির সময়।

কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের গ্রেপ্তার করছে পুলিশ। ছবি: রয়টার্স

এ ঘটনার পরই যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ফুঁসে উঠেছেন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। কলাম্বিয়ার পক্ষে অবস্থান নিয়ে গত ১০ দিনে দেশটির ২৮টির বেশি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তাঁবু খাটিয়ে দাবি আদায়ে অবস্থান শুরু করেছেন হাজারো শিক্ষার্থী।

নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি, ইয়েল ইউনিভার্সিটি, এমরি ইউনিভার্সিটি, টেক্সাস ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অফ সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া (ইউএসসি), নর্থইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি, রচেস্টার, এমআইটি, প্রিন্সটন, হাভার্ডসহ আন্দোলন চলা প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ই পুলিশ কমবেশি সংঘর্ষে জড়িয়েছে, বিক্ষোভকারীদের আটক করেছে।

প্রতিটি ক্যাম্পাসেই সার্বক্ষণিক বিপুল সংখ্যক পুলিশের উপস্থিতি রয়েছে। অন্যদিকে, আন্দোলন বন্ধের অনুরোধ জানিয়ে শিক্ষার্থীদের মেইল পাঠানো থেকে শুরু করে আবাসিক হল বন্ধ, অনলাইন ক্লাস চালুর মতো সিদ্ধান্ত নিচ্ছে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন।

এ বিষয়ে আন্দোলনরত ইউএসসি'র শিক্ষার্থী ওমর জেগার বিবিসিকে বলেন, 'আমার বিশ্বাস কলাম্বিয়া একটি বৃহত্তর আন্দোলনের সূচনা করেছে। দেশজুড়ে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় এখন ক্যাম্পাসে তাঁবু খাটিয়ে অবস্থান করতে শুরু করেছে। আরও অনেক বিশ্ববিদ্যালয় আন্দোলনে যোগ দেবে। পুলিশই এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী।'

কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁবু খাটিয়ে আন্দোলনকারীদের অবস্থান। ছবি: রয়টার্স

বাইডেন প্রশাসনের গাজা নীতির কঠোর সমালোচনা করে ডেমোক্র্যাট রাজনীতিবিদ, মিনেসোটা প্রতিনিধি ইলহান ওমর বিবিসিকে বলেন, 'এটি একটি আন্দোলন যা মাত্র ৭০ জন শিক্ষার্থী শুরু করেছিলেন। কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি প্রশাসন পুলিশ ডেকে তাদেরকে দমন করার সিদ্ধান্ত নেয়। এটা স্পষ্টই নীতিমালার লঙ্ঘন, সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এটি এখন জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে ইস্যুতে পরিণত হয়েছে।'  

কারা এই আন্দোলনকারী?

মার্কিন সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একাধিক বিবৃতিতে জানিয়েছে, এই আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য ইহুদিদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়ানো। এক শ্রেণির স্বার্থান্বেষী মহলের প্ররোচনায় শিক্ষার্থীদের পা না দেওয়ার আহ্বান জানান তারা। তবে বিবিসি, টেলিগ্রাফ আল জাজিরায় প্রকাশিত ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এক ডজন ভিডিওতে দেখা গেছে, আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটি বড় অংশ মুসলিম হলেও সব ধর্ম ও জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য। এমনকি অনেক ইহুদি শিক্ষার্থীও সেখানে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁবু খাটিয়ে আন্দোলনকারীদের অবস্থান। ছবি: রয়টার্স

এর মধ্যে কলাম্বিয়াতে 'গাজা সলিডারিটি ক্যাম্পমেন্ট' নামে শিক্ষার্থীদের একটি জোট ও নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে 'এনওয়াইইউ প্যালেস্টাইন সলিডারিটি কোয়ালিশন' আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছে। 'কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি অ্যাপার্টহেড ডাইভেস্ট (সিইউএডি)', 'স্টুডেন্টস ফর জাস্টিস ইন প্যালেস্টাইন' এবং 'ইহুদি ভয়েস ফর পিস' নামে তিনটি ছাত্র সংগঠনের জোট 'গাজা সলিডারিটি ক্যাম্পমেন্ট'। অন্যদিকে 'এনওয়াইইউ প্যালেস্টাইন সলিডারিটি কোয়ালিশন' জোটে আছে 'স্টুডেন্টস ফর জাস্টিস ইন প্যালেস্টাইন', 'ফ্যাকাল্টি ফর জাস্টিস ইন প্যালেস্টাইন', 'ল স্টুডেন্টস ফর জাস্টিস ইন প্যালেস্টাইন', 'শাট ইট ডাউন এনওয়াইইউ', 'জিউস অ্যাগেইনস্ট জায়ানিজম'সহ আরও ২০ টিরও বেশি ছাত্র সংগঠন।

ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে পুলিশি অভিযানে আটক হয়েছেন ডেমোক্র্যাট রাজনীতিবিদ, মিনেসোটা প্রতিনিধি ইলহান ওমরের মেয়ে ও গ্রিন পার্টির প্রেসিডেন্ট প্রার্থী জিল স্টেইন।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিপুল সংখ্যক নামকরা অধ্যাপক ও অ্যালামনাইরা প্রকাশ্যে এই আন্দোলনের পক্ষে সমর্থন জানিয়েছেন।

টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের গ্রেপ্তার করছে পুলিশ। ছবি: রয়টার্স

বড় ঝুঁকি সত্ত্বেও যে দাবিতে অনড় শিক্ষার্থীরা

একদিকে স্কলারশিপ, আবাসন সুবিধা ও ছাত্রত্ব বাতিলের ঝুঁকি অন্যদিকে ফৌজদারি ধারায় মামলার ঝুঁকি সত্ত্বেও নিজেদের দাবিতে শক্ত অবস্থান নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা।

তাদের প্রধান দাবি, ফিলিস্তিনের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের যুদ্ধ থেকে লাভবান হচ্ছে এমন করপোরেশনের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে কারা বিনিয়োগ করছে তাদের তথ্য এবং অন্যান্য আর্থিক বিষয়ে স্বচ্ছতাও দাবি করেছে শিক্ষার্থীরা। ইসরায়েলি বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রোগ্রামগুলোর সঙ্গে একাডেমিক সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে। ইসরায়েলের কাছ থেকে আর্থিক সহযোগিতা নেওয়া ও ইসরায়েলে বিনিয়োগ বন্ধ করতে হবে।

গ্রেপ্তার শিক্ষার্থীদের মুক্তির দাবিতে শিক্ষকদের অবস্থান। ছবি: রয়টার্স

এছাড়া সম্প্রতি ফিলিস্তিনের পক্ষে কথা বলায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আটক-হয়রানি বন্ধ করতে হবে। আটকদের মুক্তি দিতে হবে ও আন্দোলনকারীদের সুরক্ষা নিশ্চিতের দাবিও জানানো হয়েছে।

শিক্ষার্থীরা বলছেন, ফিলিস্তিনে শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং একাডেমিক প্রতিষ্ঠানের ওপর উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েল। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, অক্টোবরে সংঘাত শুরুর পর থেকে ফিলিস্তিনের ৮০ শতাংশ স্কুল ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়ে গেছে। ২৬১ জন শিক্ষক এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯৫ জন অধ্যাপকসহ প্রায় সাড়ে ৫ হাজার শিক্ষার্থী নিহত হয়েছে।

কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁবু খাটিয়ে আন্দোলনকারীদের অবস্থান। ছবি: রয়টার্স

শিক্ষার্থীদের বিশ্বাস, এই হামলাগুলো কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এটি ফিলিস্তিনি সমাজের ভিত্তিকে ভেঙে ফেলার জন্য উদ্দেশ্যমূলকভাবে করা হচ্ছে।

এনওয়াইইউ-এর সিনিয়র শিক্ষার্থী এট্টা (ছদ্মনাম) আল জাজিরাকে বলেন, 'ফিলিস্তিনের শিক্ষা ব্যবস্থাকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে এটা আমাদের দায়িত্ব ফিলিস্তিনের সেই প্রতিষ্ঠানগুলোর ধ্বংসের কথা স্বীকার করা। এর বিরুদ্ধে কথা বলা।'

ফিলিস্তিনের পক্ষে আন্দোলন দমনে একাট্টা সব পক্ষ

আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেমিক উভয় পার্টিই এই আন্দোলন দমনের পক্ষে।

ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্মের পর থেকেই ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে পাশে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। গাজায় যতই মানবাধিকার লঙ্ঘিত হোক, যতই বেসামরিক মানুষের মৃত্যু হোক, যুক্তরাষ্ট্র দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ইসরায়েলকে সমর্থন জানিয়ে যাচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্র প্রতি বছর ইসরায়েলকে ৩.৮ বিলিয়ন ডলার সামরিক সহায়তা দিয়ে থাকে। চলমান সংঘাতের মধ্যে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইসরায়েলের প্রতি দৃঢ় সমর্থন জানিয়েছেন এমনকি নিজে ইসরায়েল সফরও করেছেন। গত সপ্তাহে বাইডেন একটি তহবিল প্যাকেজ আইনে সই করেছেন, যা ইসরায়েলকে অতিরিক্ত ১৭ বিলিয়ন ডলার সরবরাহ করবে।

ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়াতে আন্দোলনকারীদের গ্রেপ্তার করছে পুলিশ। ছবি: রয়টার্স

এর আগে চার বছরের ক্ষমতার মেয়াদে ডোনাল্ড ট্রাম্পও ইসরায়েলের ঘোর সমর্থক ছিলেন। মার্কিন কংগ্রেসে ডেমোক্রেটিক ও রিপাবলিকান পার্টির বেশিরভাগ সদস্য প্রকাশ্যেই ইসরায়েলকে সমর্থন করে থাকেন। দেশটির গণমাধ্যমকেও সবসময় ইসরায়েলের পক্ষে অবস্থান নিতে দেখা যায়।

ফলে, যুক্তরাষ্ট্রের মর্যাদাপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর বিপুল অংশগ্রহণে ফিলিস্তিনের পক্ষে অবস্থান দেশটির নীতিনির্ধারকদের অস্বস্তিতে ফেলেছে। এর আগে আর কখনোই যুক্তরাষ্ট্রে ফিলিস্তিনের পক্ষে এত মানুষের প্রত্যক্ষ সমর্থন দেখা যায়নি।

শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনকে 'ইহুদি বিরোধী আন্দোলন' তকমা দিয়ে প্রতিরোধ করছে মার্কিন সরকার। তাদের দাবি, আন্দোলনকারীরা অ্যান্টি-সেমিটিজম বা ইহুদি বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে এবং তাদের কারণে যুক্তরাষ্ট্রে থাকা ইহুদি নাগরিক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ইহুদি শিক্ষার্থীরা হুমকির মুখে পড়ছে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো ব‌াইডেন কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের 'ইহুদি-বিদ্বেষী আন্দোলনকারীদের' প্রতি নিন্দা জানিয়েছেন। এ আন্দোলনকে 'বিপজ্জনক' উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'কোনো কলেজ ক্যাম্পাস, আমাদের দেশের কোথাও এর কোনো স্থান নেই।'

এ বিষয়ে পৃথক বিবৃতি দিয়েছে হোয়াইট হাউস। এতে বলা হয়েছে, 'ইহুদি শিক্ষার্থী এবং ইহুদি সম্প্রদায়কে লক্ষ্য করে হামলার ভয় দেখাচ্ছে' আন্দোলনকারীরা।

ইউসিএলএ বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁবু খাটিয়ে আন্দোলনকারীদের অবস্থান। ছবি: রয়টার্স

নিউইয়র্ক সিটির মেয়র এরিক অ্যাডামস এবং নিউইয়র্ক স্টেটের গভর্নর ক্যাথি হোচুলও আন্দোলনের নিন্দা জানিয়েছেন।

কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউইয়র্কের ক্যাম্পাসে গিয়ে মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার মাইক জনসন বলেছেন, 'শিক্ষার্থীদের বলব ক্লাসে ফিরে যাও। আমরা বাকস্বাধীনতায় শ্রদ্ধা করি। আমরা চিন্তার বৈচিত্র্যকে সম্মান করি। কিন্তু এটা করার একটা উপায় আছে, আইনত পদ্ধতি আছে। তোমরা যা করছ, সেটা না।'

অন্যদিকে, এ আন্দোলনকে বাইডেন প্রশাসনের ব্যর্থতা বলে দাবি করেছেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। আন্দোলনকারীদের আরও শক্ত হাতে দমন করা উচিত ছিল বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।

তবে গণমাধ্যমসহ রাষ্ট্রীয় বাহিনী ও সরকারের সব পক্ষ শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে 'হামাসের প্রতি সহানুভূতিশীল', 'ইহুদি বিদ্বেষী', 'সন্ত্রাসী' হিসেবে চিত্রিত করে ইসরায়েলপন্থী সংগঠন ও কমিউনিটিকে তাদের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ করে তোলা হয়েছে।

ইতোমধ্যেই শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ জানাচ্ছে কয়েকটি গ্রুপ। ইসরায়েলের পতাকা হাতে তারা শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে স্লোগান দিচ্ছে। এর ফলে ক্রমশ দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষের আশঙ্কা দেখা যাচ্ছে।

নিউইয়র্কে কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসের বাইরে ইসরায়েলপন্থীদের পাল্টা প্রতিবাদ কর্মসূচি। ছবি: সংগৃহীত

এটি 'ইহুদি বিরোধী আন্দোলন' এমন দাবি তীব্রভাবে প্রত্যাখ্যান করে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কারভাবে তুলে ধরছেন আন্দোলনকারীরা। তারা বলছেন, 'আমরা গণহত্যা বিরোধী, ইহুদি বিরোধী নই।'

ফিলিস্তিনে গণহত্যার বিরুদ্ধে আন্দোলন করার কারণে দেশসেরা শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে পুলিশি অভিযানের সিদ্ধান্ত নেওয়ায় মার্কিন সরকারের বিরুদ্ধে বিশ্বজুড়ে নিন্দা চলছে। এতদিন ধরে চীন কিংবা রাশিয়ার বিরুদ্ধে দমন নিপীড়নের বিরোধিতা করে আসা মার্কিন সরকারের এ সিদ্ধান্তে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম জুড়ে তুমুল সমালোচনা চলছে।

জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন। ছবি: রয়টার্স

যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এই আন্দোলনে সংহতি জানিয়েছে অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ফ্রান্স, ইতালি, যুক্তরাজ্যসহ আরও কয়েকটি দেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা। অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়, সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়, কনকর্ডিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, ফ্রান্সের প্যারিস ইনস্টিটিউট অব পলিটিক্যাল স্টাডিস, সরবন বিশ্ববিদ্যালয়, ইতালির স্যাপিনজা বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাজ্যের লিড ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন, ওয়ারউইক ইউনিভার্সিটিতে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়ের এই আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেছে।

Comments