খুলনায় তীব্র গরম: লোকসানে তিন লাখ চিংড়ি চাষি

‘এ পর্যন্ত প্রায় আড়াই লাখ টাকা খরচ করেছি। এত ঝুঁকি নেওয়ার মতো টাকা আমার নেই।’
চিংড়ি চাষ
খুলনার চিংড়ির ঘের গভীর করে খনন করেও পানি ধরে রাখা যাচ্ছে না। ছবি: সংগৃহীত

দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলা খুলনার চিংড়ি চাষিরা চলতি বছর মারাত্মক ক্ষতিতে পড়ার আশঙ্কা করছেন। কেননা, চলমান তাপপ্রবাহে ঘেরগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে।

এ ছাড়া, প্রখর রোদে পানিতে অক্সিজেনের মাত্রা কমে যাচ্ছে বলে কয়েকজন চাষি দ্য ডেইলি স্টারকে জানিয়েছেন। উচ্চ তাপমাত্রার কারণে কম গভীরতায় সালোকসংশ্লেষণ হচ্ছে না।

সালোকসংশ্লেষণের অভাব চিংড়ির খাবার সরবরাহকেও কমিয়ে দিয়েছে। কারণ চিংড়ির খাবার শৈবাল ও অন্যান্য অণুজীব এমন পরিস্থিতিতে বেঁচে থাকতে পারে না।

অক্সিজেন ট্যাবলেট ও অন্যান্য উপকরণের পেছনে খরচ বাড়লেও অধিকাংশ চিংড়ি মরে যাওয়ায় ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়ার আশঙ্কা করছেন চাষিরা।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুসারে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-মার্চ ২৯ কোটি ৮০ লাখ ডলারের হিমায়িত ও তাজা মাছ রপ্তানি করা হয়েছে। এটি আগের বছরের তুলনায় ২১ শতাংশ কম।

মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, এক দশক আগে ৫০০ মিলিয়নের বেশি আয় হয়েছিল। রপ্তানির জন্য তখন প্রায় দুই লাখ ৬০ হাজার হেক্টর জমিতে চিংড়ি চাষ হয়।

খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলার চক শৈলমারী গ্রামের চিংড়ি চাষি বিপ্রদাস বৈরাগী দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, ৫০ শতক জমির ঘেরে ৪০ হাজার চিংড়ি পোনা ছাড়তে তার প্রায় ৪৮ হাজার টাকা খরচ হয়েছে।

চিংড়ি চাষ
খুলনার চিংড়ির ঘের গভীর করে খনন করেও পানি ধরে রাখা যাচ্ছে না। ছবি: সংগৃহীত

তিনি বলেন, 'প্রচণ্ড গরমের কথা ভেবে আমি ঘেরটি আরও গভীর করে খনন করেছি। তারপরও পানি কমে গেছে। কখনো ভাবিনি এমন বিপদে পড়ব।'

তিনি জানান, পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত করতে নিয়মিত পানি পরিবর্তন করতে হয়।

'কিন্তু পাশের খালে পানি না থাকায় ঘের ভরতে পারছি না,' উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, 'ট্যাবলেট ছাড়াও অক্সিজেনের মাত্রা বজায় রাখতে সার্বক্ষণিক ওয়াটার এয়ারেটর মেশিন ব্যবহার করতে হচ্ছে।'

বিদ্যুতের অভাবে ওয়াটার এয়ারেটর মেশিন চালু রাখতে জেনারেটর ব্যবহার করতে হচ্ছে। তাই খরচ আরও বেড়ে যাচ্ছে।

'অক্সিজেন ট্যাবলেট, জেনারেটরের খরচ ও বিদ্যুতের বিল হিসেবে চলতি মৌসুমে এখন পর্যন্ত অতিরিক্ত ২০ হাজার টাকা খরচ করেছি। এ অবস্থা চলতে থাকলে লোকসান হবেই,' যোগ করেন তিনি।

দেশে তিন সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে তাপপ্রবাহ চলছে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোর অন্যতম।

জেলার বটিয়াঘাটা, ডুমুরিয়া, দাকোপ, পাইকগাছা ও কয়রা উপজেলার চাষিরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি আশপাশের এলাকার চাষিরাও একই সমস্যায় পড়েছেন।

কয়রা উপজেলার উত্তর বেদকাশী ইউনিয়নের চিংড়ি চাষি গোগেশ মণ্ডল ডেইলি স্টারকে জানান, তিনি ১৫ দিন আগে ১০ বিঘা জমির ঘেরে চিংড়ি ছেড়েছেন।

গত কয়েকদিনে তিনি পানিতে শত শত মরা চিংড়ি ভাসতে দেখেছেন। সেগুলো পচতে যাওয়ায় পানি দূষিত হয়ে পড়েছে।

তিনি বলেন, 'স্থানীয় এলাকা থেকে এক হাজার চিংড়ি রেণু ৮০০ টাকা দরে পোনা কিনেছি। চিংড়ির খাবার ও ওষুধ কিনতে হয়েছে। ভয়ানক গরমের কারণে এখন সব আশা হারিয়ে গেছে।'

তার মতে, এ বছর চিংড়ি ব্যবসাকে বাঁচানোর একমাত্র উপায় হলো ঘের খালি করে আবার নতুন করে শুরু করা। 'এ পর্যন্ত প্রায় আড়াই লাখ টাকা খরচ করেছি। এত ঝুঁকি নেওয়ার মতো টাকা আমার নেই।'

তার গ্রামের প্রায় ৩০০ চিংড়ি চাষিও একই সমস্যায় পড়েছেন বলেও জানান তিনি।

কয়রার মৎস্য অফিস সূত্রে জানা গেছে, এ অঞ্চলের পাঁচ হাজার হেক্টর এলাকায় ছোট-বড় প্রায় চার হাজার ঘের আছে।

খুলনা মৎস্য কর্মকর্তা জয়দেব পাল ডেইলি স্টারকে বলেন, 'চিংড়ি চাষের উপযুক্ত তাপমাত্রা ২৫ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে।'

তাপপ্রবাহের সময় একটি ঘেরে কমপক্ষে তিন ফুট পানি রাখার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, 'পানির তাপ ও লবণাক্ততা বেড়ে গেলে অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দেয়। এসব কারণে চিংড়ি মারা যায়।'

বাংলাদেশ মৎস্য খামার মালিক সমিতির সভাপতি মোল্লা সামসুর রহমান শাহিন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'চলতি মৌসুমে তীব্র তাপপ্রবাহে খুলনায় অন্তত তিন লাখ চিংড়ি চাষি সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।'

'এ সময় চাষিরা চিংড়ি চাষে সব টাকা খরচ করলেও অধিকাংশ চিংড়ি মারা গেছে। সরকার বড় ধরনের প্রণোদনা না দিলে চাষিরা বড় ধরনের ক্ষতিতে পড়বেন।'

স্থানীয় মৎস্য অফিস সূত্রে জানা গেছে—খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরায় এক লাখ ৪৪ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে চিংড়ি চাষ হচ্ছে।

খুলনা আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, গত ১০ দিন ধরে এ অঞ্চলের গড় তাপমাত্রা ৪০ দশমিক তিন ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি।

Comments