ভেনিসের প্রবেশ ফি ৫ ইউরো, সমালোচিত মেয়র

এখন থেকে ১৪ বছরের বেশি বয়সের সব পর্যটককে ভেনিসের প্রবেশ ফি ৫ ইউরো পরিশোধ করতে হবে।
ভেনিস পাস বিরোধীরা প্রবেশ মুখে ব্যানার টানিয়ে দিয়েছে। ছবি: সংগৃহীত

ইতালির জলকন্যা ভেনিস পৃথিবীর এক ইউনিক শহর। পানির ওপর ভাসমান এই শহরে জীবনযাপন ব্যাপক ব্যয়বহুল। তবু ভ্রমণ পিয়াসীদের কাছে ভেনিসের আকর্ষণ অনেক ওপরে। 

গত ২৫ এপ্রিল ভেনিসের স্থানীয় সরকার একটি নতুন নিয়ম চালু করেছে, অর্থাৎ পর্যটকদের জন্য 'প্রবেশ ফি' নির্ধারণ করেছে। এখন থেকে ১৪ বছরের বেশি বয়সের সব পর্যটককে ভেনিসের প্রবেশ ফি ৫ ইউরো পরিশোধ করতে হবে।

ইউরোপের অনেক মানুষ ভেনিসকে 'শহর' হিসেবে মানতে রাজি নন। তারা ভেনিসকে একটি উন্মুক্ত মিউজিয়াম ভাবতে পছন্দ করেন। তাদের কথা হলো- মিউজিয়ামে যেমন মানুষ যায় খসে পড়া পলেস্তারা-ঐতিহ্য দেখতে, তেমনই ভেনিসে আসে 'ভেনিস' দেখতে। ভেনিসের সবকিছুই দেখার মতো। আস্ত একটা বিস্ময় শহর ভেনিস।

একটি আদর্শ শহরে যা কিছু থাকে তার সবই আছে ভেনিসে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, স্টেডিয়াম, আদালত, জেলখানা, উপাসনালয়, হাসপাতাল, মিউজিয়াম, অফিস, নগর ভবন, সুপার মার্কেট, শপিং মল ও থানা-পুলিশ সব। হোটেল, মোটেল, বার ও রেস্টুরেন্টও আছে অনেক।

এতকিছু মাথায় নিয়ে ভেনিস দাঁড়িয়ে আছে ভূমধ্যসাগরের পেটের ওপর। এই শহরের অবকাঠামো সত্যিই অবিশ্বাস্য। পানির ওপর ভেসে আছে বড় বড় দালান-কোঠা। জোয়ার হলে তলিয়ে যায় শহর। রাস্তা-ঘাটে হাঁটু পানি জমে। শহরটাকে লতার মতো পেঁচিয়ে আছে ১৭৭টি খাল। প্রায় সাড়ে চারশ ছোট বড় সেতু আছে এই শহরের যোগাযোগ সহজ করতে। আর যানবাহন বলতে শুধু নৌযান। লঞ্চ, নৌকা ও স্টিমার।

আপনি যদি ভেনিসে বসে ট্যাক্সি কল করেন, মুহূর্তের মধ্যে পানি দাপিয়ে ছুটে আসবে স্পিডবোট। পুলিশ, অ্যাম্বুলেন্সও ওই স্পিডবোটের মধ্যেই। এই শহরে 'প্রাইভেট কার' মানে ডিঙ্গি নৌকা বা ইঞ্জিন লাগানো ট্রলার। ভেনিসের প্রতিটি অলি-গলি দেখার মতো। হাজার বছরের ঐতিহ্য ছড়িয়ে আছে কদমে কদমে। যা কোনোভাবেই দেখে শেষ করা যায় না।

যারা ভেনিসকে মিউজিয়াম ভাবতে পছন্দ করেন, তাদের আরেকটা যুক্তি হলো- পৃথিবীর কোনো বিখ্যাত টুরিস্ট অঞ্চল ঘুমায় না। টুরিস্টদের জন্য ২৪ ঘণ্টা বিনোদনের ব্যবস্থা থাকে। সেই অর্থে ভেনিসে এরকম কিছুই নেই। অন্য পাঁচটা শহরের মতো রয়েছে বার, রেস্টুরেন্ট, হোটেল ও মোটেল, ইত্যাদি। তা-ও মধ্যরাতের মধ্যে বন্ধ হয়ে যায়। রাত ১২টার পর ভেনিসে খাবার খুঁজে পাওয়াও প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। একমাত্র ক্যাসিনো ছাড়া ভেনিসে রাত জাগার কোনো বন্দোবস্ত নেই টুরিস্টদের জন্য।

ঘড়ির কাটা ধরে দরজা খোলা-বন্ধ করা, বিস্ময়কর এই পর্যটন নগর নিয়ে এখন চলছে চরম আলোচনা-সমালোচনা। বর্তমান মেয়র ও ডানপন্থী রাজনীতিক লুইজি ব্রুনারো ভেনিসে প্রবেশ ফি (ভেনিস পাস) চালু করে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছেন।

মেয়র ব্রুনারো বলেন, 'ভেনিসে প্রতিদিন প্রায় দুই লাখ মানুষের আসা-যাওয়া হয়। বিশেষ করে উইকেন্ডে এবং উৎসবের সময়ে এত বেশি ভিড় হয়, প্রশাসনকে নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকতে হয়। যা ভেনিসের জন্য, পর্যটকদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। তাছাড়া শহরের মেনটেইন খরচ অনেক বেড়ে যায়।'

২৫ এপ্রিল উদ্বোধনের (ভেনিস পাস) দিনই ভেনিসের অনেক নাগরিক মেয়রের এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়েছেন। সংঘবদ্ধ প্রতিবাদ সমাবেশ করেছেন। তারা কোনোভাবেই 'ভেনিস পাস' মানতে রাজি নন। মেয়রের সিদ্ধান্তকে তারা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত বলে মনে করেন।

তাদের মতে এতে পর্যটকদের অধিকার লঙ্ঘন করা হবে। কারণ পৃথিবীর কোনো শহরে 'প্রবেশ ফি' দিতে হয় না। ভেনিসই প্রথম।

ভেনিসের সাবেক মেয়র ও দার্শনিক মাচ্ছিমো কাচ্চারি বর্তমান মেয়র লুইজি ব্রুনারোর কড়া সমালোচনা করে বলেছেন, 'সে ভেনিসকে ধ্বংস করতে চায়। ভেনিসের প্রতি পর্যটকদের ঘৃণা সৃষ্টি করতে চায়। যা ঐতিহাসিক ভেনিসের ঐতিহ্য নষ্ট করবে, পতন ডেকে আনবে।'

ভেনিসের বাংলাদেশি ব্যবসায়ী রিটন ঢালি বলেন, 'ঐতিহ্যগতভাবে ইতালির মানুষ অতিথিপরায়ণ। ভেনিসের স্থানীয় মানুষরা পর্যটকদের অতিথির নজরে দেখে। তাদের সম্মান করে। ভেনিসের প্রবেশ ফি তাদের এই ঐতিহ্য নষ্ট করবে। ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।' 

তিনি বলেন, 'ভেনিসের, তথা ইতালির আর্থিক অবস্থা এতটা খারাপ হয়নি যে, একটি পর্যটন শহরে প্রবেশ ফি নির্ধারণ করতে হবে।'

'ভেনিসে যারা থাকেন, সবাই সিটি ট্যাক্স দিয়ে থাকেন। এতেই স্থানীয় সরকারের প্রতিদিন লাখ লাখ ইউরো ইনকাম হয়। তবু কেন প্রবেশ ফি নির্ধারণ করতে হবে', যোগ করেন রিটন।

আগামী বছর ভেনিসের সিটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। শোনা যাচ্ছে, বর্তমান মেয়র আর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন না। তিনি অবসরে যাবেন। এর আগে কেন তিনি এমন একটা সিদ্ধান্ত নিলেন, যা স্থানীয় মানুষকে ব্যাপক ক্ষুব্ধ করেছে। ভেনিসের রাজনৈতিক পাড়ায় এটা নিয়ে ব্যাপক কথা হচ্ছে। আসন্ন নির্বাচনে 'ভেনিস পাস' একটা ইস্যু হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

Comments